উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - জীবন ও জীবিকা - Life and Livelihood - NCTB BOOK

উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা

মনের মতো সাজাও ব্যবসা, মেধা মনন দিয়ে

হার নেই তোমার, আগাও যদি নতুন ধরন নিয়ে!

আমাদের চারপাশে রয়েছে নানা রকমের উপকরণ। অন্যদিকে মানুষের রয়েছে নানা রকমের চাহিদা। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ব্যবহার হয়ে আসছে চারপাশের এই উপকরণ। সময়ের সাথে সাথে চাহিদায় এসেছে পরিবর্তন, কারো না কারো হাত ধরে এসব উপকরণও সেজেছে বৈচিত্র্যময় আবহে! এভাবে সৃজনশীল উপস্থাপনায় নিত্য নতুন উপকরণ সামনে এনে হাজির করেন যারা, নিঃসন্দেহে তারা উদ্ভাবক! উদ্ভাবনী চিন্তা আমাদের আগামীতে টিকে থাকার শক্তি যোগাবে। আমরা তাই উদ্ভাবক হয়ে উঠতে চাই, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই। নিজের প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে চাই, যা দিয়ে হতে পারে একটি সফল ক্যারিয়ারের সূচনা।

তোমরা কি লক্ষ করেছ তোমাদের আশপাশে প্রাকৃতিক উপাদান ছাড়া আর যা কিছু আছে, তার সব কিছুই কেউ না কেউ তৈরি করছে, সংগ্রহ করছে, পরিবহন করছে বা বিক্রি করছে। আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি, তার সঙ্গে বিভিন্ন রকম ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড জড়িত। এছাড়াও, প্রায় সব সেবার সঙ্গেও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড জড়িত। যেমন: পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ইন্টারনেট সার্ভিস, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। প্রতিটি উপাদান সংগ্রহে বা সেবা গ্রহণের জন্য আমাদের অর্থ ব্যয় করতে হয়। এসব কিছুই কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে। ব্যবসায় সাধারণত দুইটি পক্ষ থাকে: এক পক্ষ পণ্য বা সেবা সরবরাহ করে, আরেক পক্ষ পণ্য বা সেবা অর্থের বিনিময়ে গ্রহণ করে।

চলো, আমরা সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবসায়ের জন্য কিছু আইডিয়া তৈরি করি। আইডিয়াটি এমন হতে হবে, যাতে আগামীতে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যে অনুষ্ঠান হবে, সেখানে এই ব্যবসায়িক প্রকল্পটি আমরা পরিচালনা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। আমরা আমাদের সৃষ্টিশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি, সক্ষমতা এবং অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের চাহিদা বিবেচনা করে ব্যবসায়িক প্রকল্পের আইডিয়ার নকশা তৈরি করব। দলগতভাবে প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা করব, পণ্য তৈরি বা সংগ্রহ করব। সেবা- সংশ্লিষ্ট আইডিয়া হলে, সেবা প্রদানের জন্য কী কী উপাদান লাগবে তার তালিকা তৈরি করব, ব্যবসাটি করতে মূলধন কত লাগবে এবং তার জোগান কীভাবে হবে তা নির্ধারণ করব। অনুষ্ঠানের দিনে দলের কে কোন কাজ করব, তার দায়িত্ব ভাগ করে নেব। পণ্য বা সেবার মূল্য কত হবে অর্থাৎ ব্যবসাটি পরিচালনা করার জন্য যা যা করা দরকার, পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করব।

ফিরে দেখা

ব্যবসায়িক আইডিয়া বা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর, আমরা নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে চাই! এজন্য আমরা দলে আলোচনা করে প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করব। প্রতিবেদন প্রস্তুতির সময় ছক ২.১ এর প্রশ্নগুলো বিবেচনা করব।

ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি

ভবিষ্যতের উদ্যোক্তা! আমরা কি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী? প্রথম দিকে একটা ব্যবসা শুরু করা বেশ কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু ব্যবসা শুরু করার বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হলে আমরা নিজেই একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। চলো, আমরা ব্যবসা শুরু করার ধাপগুলো সংক্ষেপে জেনে নিই-

ক্ষুদ্র ব্যবসায় শুরু করার ধারাবাহিক ধাপ

নিজের পছন্দ ও আগ্রহ ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমরা কী করতে পছন্দ করি, কোন ধরনের কাজে আমাদের সহজে ক্লান্তি আসে না, কোন ধরনের সমস্যা সমাধানে আমাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, তা আবিষ্কার করতে হবে। আমাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ উপভোগ্য ও টেকসই হবে, যদি তা আমাদের ভালোলাগা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। সম্ভাব্য ব্যবসায়িক ধারণাগুলো শনাক্ত করতে আমাদের আগ্রহ, দক্ষতা এবং আবেগের প্রতিফলন খুঁজে বের করতে হবে।

ধাপ-১: ব্যবসায় আইডিয়া নির্দিষ্ট করা

এই ধাপে একটি ব্যবসায়িক আইডিয়া সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আইডিয়া নির্বাচন করতে একদিকে যেমন আমাদের নিজের পছন্দ, দক্ষতা ও আগ্রহকে বিবেচনা করতে হবে, তেমনি সম্ভাব্য ক্রেতার আগ্রহ, চাহিদা ও সক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের বিষয়েও ভাবতে হবে। আইডিয়া তৈরির জন্য নিচের প্রশ্নগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

ক) আমরা যে ধরনের ব্যবসা করতে ইচ্ছুক, তার কোনটি সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে ভালো ধারণা আছে? (উদাহরণস্বরূপ, সেবা খাতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা আছে; যেমন: নার্সারি, খাবার সরবরাহ (ফুড ডেলিভারি সার্ভিস), বিউটি পার্লার, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং ইত্যাদি। সেবা খাতের কোন ব্যবসা সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে ভালো ধারণা আছে, তা বিবেচনা করতে হবে।

খ) ব্যবসায়-সংশ্লিষ্ট কোন কোন কাজে আমাদের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে? যেমন: ধরা যাক, আমরা যদি খাদ্য প্রস্তুত ও বিক্রির ব্যবসা বিবেচনা করি, তবে কোনো খাদ্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে? সেবামূলক ব্যবসার ক্ষেত্রেও একইভাবে নির্ধারণ করতে হবে, কোন সেবা প্রদানে আমাদের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে।

উপরোক্ত বিষয় বিবেচনা করে আমরা আমাদের ব্যবসার আইডিয়াটি সুনির্দিষ্ট করব।

ধাপ-২: বাজার যাচাই ও ফলাফল বিশ্লেষণ

এই ধাপে আমাদের বাজার যাচাই করতে হবে। বাজার যাচাই করতে একদিকে যেমন আমাদের ব্যবসায়িক পণ্য বা সেবার সম্ভাব্য ক্রেতা সম্পর্কে জানতে হবে, তেমনি এই বাজারে সম্ভাব্য প্রতিযোগী অর্থাৎ অন্যান্য যাঁরা একই ব্যবসা করছেন, তাদের সম্পর্কেও ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। বাজার যাচাইয়ের জন্য কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে পারে। যেমন:

বাজার যাচাই করে আমরা যদি ইতিবাচক সাড়া পাই অর্থাৎ যদি বুঝতে পারি যে, আমাদের পণ্য বা সেবার পর্যাপ্ত সংখ্যক সম্ভাব্য ক্রেতা রয়েছে, অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে টিকে থাকার সামর্থ্য রয়েছে এবং আমাদের পণ্য/সেবার কাছাকাছি খুব বেশি পণ্য বা সেবা নেই, তাহলে আমরা সেই ব্যবসায়িক আইডিয়া বাস্তবায়নে এগিয়ে যাব। কিন্তু যদি উত্তর নেতিবাচক হয়, তাহলে আমাদের ব্যবসায়ের আইডিয়াটি সংশোধন করতে হবে।

ধাপ ৩: ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রণয়ন

এই ধাপে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় ব্যবসার লক্ষ্য, সম্ভাব্য ক্রেতা, পণ্য/ সেবা, বিপণন কৌশল এবং ব্যবসার আয়-ব্যয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকতে হবে। ব্যবসায়টি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কি না তা যাচাই করে দেখতে হবে। ব্যবসায়ের কাঁচামাল এবং বর্জ্য পরিবেশ দূষণের কারণ হচ্ছে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে উক্ত ব্যবসায় পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণে প্রাণিকুলের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান বা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেই বিষয়টিও বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিশোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়টিও পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ধাপ-৪: ব্যবসার জন্য আর্থিক চাহিদা নিরূপণ

ব্যবসা শুরু করার খরচ এবং চলমান খরচ নির্ণয় করতে হবে। ব্যবসা শুরু করতে এবং ব্যবসা চালিয়ে যেতে কত টাকা লাগবে তার একটি সুস্পষ্ট হিসাব করতে হবে। ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নিরূপণে বিষয়গুলোকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে।

ব্যবসার জন্য নিরূপণকৃত আর্থিক চাহিদা অনুসারে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে হবে। অর্থ সংস্থানে আমরা আমাদের সঞ্চয় ব্যবহার করতে পারি। যদি সঞ্চয়ের পরিমাণ কম হয়, তাহলে আমাদের পারিবারের কাছ থেকে কিংবা বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারি। প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পর আমরা পরবর্তী ধাপের কার্যক্রম শুরু করব। ব্যবসার আইডিয়া যদি অনন্য বা অত্যন্ত লাভজনক মনে হয়, তবে ব্যাংক বা বিনিয়োগকারী আমাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে রাজি হতে পারে।

ধাপ-৫: ব্যবসার সম্ভাব্য আয়, ব্যয় ও মুনাফা নির্ধারণ এবং আর্থিক বিশ্লেষণ

এই পর্যায়ে ব্যবসার সম্ভাব্য আয়, ব্যয় ও মুনাফা নির্ধারণ এবং আর্থিক দিকসমূহ বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যবসা বা পরিকল্পিত ব্যবসায়িক প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণ (আয়, ব্যয় ও মুনাফা) নির্ধারণের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবসা শুরুর পর তা থেকে যে আয় পাওয়া যাবে, তা হিসাব করা। উক্ত আয় অর্জনে কত পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা নির্ণয় করা। অর্থাৎ ব্যবসা বা প্রকল্পটির সম্পূর্ণ মেয়াদে আয়-ব্যয়ের তুলনা করে মুনাফা অর্জন ক্ষমতা নির্ধারণ করা।

কোনো ব্যবসায় শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত মূলধন-জাতীয় ব্যয় হয়ে থাকে। প্রাথমিক ব্যয়, দোকান/ জমির মূল্য, সংস্থাপন ব্যয়, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ব্যয়, নির্মাণ ব্যয়, প্রকৌশল এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় ইত্যাদি মূলধন ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। আর ব্যবসা বা বিনিয়োগ উদ্যোগকে চালু রাখার জন্য প্রতিনিয়ত যে মূলধনের প্রয়োজন হয়, তাকে চলতি মূলধন বলা হয়। কোনো ব্যবসায়ের উদ্যোগে বা প্রকল্পে উৎপাদন কার্যক্রম জড়িত থাকলে এককালীন মূলধন বেশি প্রয়োজন হয়। আবার পণ্য বিক্রয়জনিত ব্যবসায় চলতি মূলধন বেশি প্রয়োজন হয়। চলতি বা কার্যকরী মূলধনের পরিমাণ নির্ভর করে উৎপাদন, মজুদ মাত্রা, জ্বালানি, কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশের চাহিদা ও মার্কেটিংয়ে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ওপর। সম্ভাব্য বিক্রয়ের পরিমাণ এবং একক বিক্রয়মূল্যের উপর সম্ভাব্য আয় নির্ভর করে।

অন্যদিকে উৎপাদনভিত্তিক প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার পর কার্যক্রম বা পরিচালনা ব্যয়ের (operating cost) প্রয়োজন হয়। এটা দুই ভাগে বিভক্ত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয়। উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও শ্রম ব্যয়কে প্রত্যক্ষ ব্যয় এবং অন্য আনুষাঙ্গিক ব্যয়কে পরোক্ষ ব্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়।

পরিকল্পিত ব্যবসার প্রাক্কলিত আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে সম্ভাব্য মুনাফা নির্ণয় করা হয়। মুনাফা নির্ধারণে অবচয় ব্যয় বিবেচনা করতে হয়। ব্যবসায় যে যন্ত্রপাতি বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তার নির্দিষ্ট মেয়াদকাল রয়েছে। অর্থাৎ যন্ত্রপাতি বা উপকরণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবচয় বা এর কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। অবচয় ব্যয় হিসাব করতে এসব যন্ত্রপাতি ও উপকরণে প্রতিবছর কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে, তা বের করা হয়। যেমন: যদি কোনো যন্ত্র ১০০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করা হয় এবং ৫ বছর পরে যন্ত্রটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়, তবে সেই যন্ত্রের বার্ষিক অবচয় ব্যয় হলো ১০০০/৫= ২০০ টাকা। মুনাফা নির্ণয়ে আয় থেকে অবচয় ব্যয় বাদ দিতে হয়। সেই সঙ্গে উক্ত ব্যবসায়ের জন্য প্রযোজ্য কর হিসাব করে তা-ও মূল আয় থেকে বাদ দিয়ে মুনাফা হিসাব করতে হয়।

ক্রয়মূল্য নির্ধারণ

সাধারণ অর্থে পণ্য ক্রয়ের সময় যে দাম বা মূল্য প্রদান করা হয়, তাকে ক্রয়মূল্য বলা হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে, পণ্যের দাম এবং পণ্যের বিক্রয় স্থান বা দোকান পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানোর যাবতীয় খরচের সমষ্টি হলো ক্রয়মূল্য। ক্রয়কৃত পণ্যের দামের সঙ্গে প্যাকেটজাত করার খরচ, পরিবহণ খরচ, কুলির মজুরি ইত্যাদি যোগ করে যে মূল্য নিরূপণ করা হয়, তা-ই ক্রয়মূল্য নামে পরিচিত।

পণ্য ক্রয়ের জন্য সরাসরি প্রদত্ত মূল্যের পাশাপাশি পণ্য বিক্রয়স্থলে আনার জন্য যাবতীয় খরচের সমষ্টি অর্থাৎ পরিবহন ও কুলি, ক্রয় শুল্ক বা কর, প্যাকেটজাতকরণ ও বীমা খরচ ইত্যাদি পণ্যের ক্রয়মূল্যের সঙ্গে যোগ করে পণ্যের প্রকৃত বা মোট মূল্য নিরূপণ করা হয়।

যেমন: একজন ব্যবসায়ী চকবাজার থেকে ১৫০ টাকা দরে ৫০টি খেলনা কিনলেন। তিনি খেলনাগুলো তার ব্যবসাকেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য ২০০ টাকা পরিবহন ভাড়া, ১০০ টাকা ক্রয় শুল্ক, ১০০ টাকা বীমা খরচ এবং ২০০ টাকা কুলির মজুরি প্রদান করেন।

এক্ষেত্রে খেলনার মোট ক্রয়মূল্য হবে:

প্রতিটি খেলনার ক্রয়মূল্য হবে (৮১০০/৫০) = ১৬২ টাকা

উৎপাদন ব্যয় বের করি

কোনো পণ্য উৎপাদন বা সেবা প্রদানের জন্য যে খরচ হয়, তা-ই হলো উৎপাদন ব্যয়। অর্থাৎ, কোনো পণ্য উৎপাদন বা সেবা প্রদান করতে বা সৃষ্টি করতে যে খরচ হয়, তা উৎপাদন ব্যয় হিসাবে পরিচিত কোনো দ্রব্য কারখানায় উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল থেকে শুরু করে দ্রব্যটি ব্যবহার উপযোগী করা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে খরচ হয়, এই সবকিছুর সমষ্টিই হলো ঐ দ্রব্যের উৎপাদন ব্যয়। যেমন: কাপড়ের মিলে তৈরির জন্য ব্যবহৃত সুতা, রং ও শ্রমের জন্য প্রদত্ত মূল্য, যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ব্যয় এবং অন্যান্য খরচের সমষ্টিকে বলা হবে কাপড় উৎপাদন ব্যয়। তেমনি ইট তৈরির কারখানায় বালু, মাটি, মজুরি, ইট পোড়ানোর খরচের সমষ্টিই হলো ইটের উৎপাদন ব্যয়।

বিক্রয়মূল্য নিরূপণ করি

ক্রয়মূল্যের সঙ্গে ব্যবসার পরোক্ষ ব্যয়গুলো যেমন: কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া, বিজ্ঞাপন, বিদ্যুৎ ও যাতায়াত খরচ ইত্যাদি যোগ করে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এরূপ ব্যয়ের সঙ্গে প্রত্যাশিত মুনাফা যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়। আমরা একটি উদাহরণের সাহায্যে বিক্রয়মূল্য কেমন হয়, তা দেখবো।

পূর্বে প্রদত্ত ক্রয়মূল্যের উদাহরণ অনুসারে খেলনার মোট ক্রয়মূল্য ছিল ৮১০০ টাকা এবং বিক্রয় করার জন্য তিনি দোকান ভাড়া ৯০০ টাকা ও কর্মচারীর বেতন বাবদ মোট ১,০০০ টাকা পরোক্ষ খরচ করেন। মোট ব্যয়ের ওপর ১০% লাভে বিক্রয় করতে হলে মোট বিক্রয়মূল্য ও প্রতিটি খেলনার বিক্রয়মূল্য হবে নিম্নরূপ:

প্রতিটি খেলনার বিক্রয়মূল্য (১১০০০/৫০) = ২২০ টাকা।

তবে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, অধিক লাভের আশায় বিক্রয়মূল্য অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করা যাবে না। কেননা, ব্যবসায়ীকে অবশ্যই ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ভোক্তাকে ঠকিয়ে কিংবা ভোক্তার নিকট থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা ব্যবসায়ের নীতিবিরুদ্ধ কাজ।

আয়-ব্যয় বিবরণী

ক্রয় ও বিক্রয়মূল্য নির্ধারণের পর সম্ভাব্য আয়-ব্যয় বিবরণী প্রস্তুত করতে হবে। একটি সম্ভাব্য আয়-ব্যয় বিবরণীর নমুনা ছক দেখে নেওয়া যাক:

সম্ভাব্য আয়-ব্যয় বিবরণী থেকে যদি দেখা যায় যে, ব্যবসায়টি লাভজনক, তাহলে শুরুর জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়।

ধাপ-৬: ব্যবসার ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং বা বিপণন পরিকল্পনা

ব্যবসায় পরিচালনার জন্য ব্যবসার একটি চমৎকার ও আকর্ষণীয় নাম দিতে হবে। ব্যবসায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি লোগো তৈরি করতে হবে। তবে অন্য নামীদামী প্রতিষ্ঠানের লোগোর কাছাকাছি বা মিল আছে এমন লোগো তৈরি করা অনুচিত, এতে ভোক্তাকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা আদায়ের বা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠতে পারে। বর্তমানে যেকোনো ব্যবসার জন্য ব্যবসায়িক কার্ড, ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যমে প্রোফাইল তৈরি করার জন্য ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্যমান (ভিজ্যুয়াল) পরিচিতি তৈরি করতে হয়। ব্যবসায়ের নাম এবং ভিজ্যুয়াল পরিচিতি যেন আকর্ষণীয় হয়, তা লক্ষ রাখতে হবে। এর পাশাপাশি এটাও লক্ষ রাখতে হবে, পরিচিতিতে অতিরঞ্জিত কিছু যেন না থাকে। কারণ তাতে ক্রেতার প্রত্যাশা বেড়ে যায়। তখন প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি না থাকায় তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

একই সঙ্গে কার্যকরভাবে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে আমাদের পণ্য বা সেবা পরিচিতি করার জন্য বিপণন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিপণন পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে পণ্য বা সেবাকে পরিচয় করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে, যাতে আমাদের পণ্য বা সেবাকে সকলের কাছে সহজেই পৌঁছানো যায়। প্রচারের সময় লক্ষ রাখতে হবে- কম সময়ে কীভাবে যথাযথ তথ্য ভোক্তার দৃষ্টিতে আনা যায়। অতিরিক্ত, অসত্য বা প্রতারণামূলক তথ্য সরবারহ করে ক্রেতার বিরক্তি উৎপাদন করা যাবে না। এতে প্রচার ও প্রসার না বেড়ে বরং প্রতিষ্ঠান বা পণ্যেরে প্রতি অনাস্থা তৈরি হবে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

ধাপ-৭: ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু ও পর্যবেক্ষণ করা

অনেক বড় পরিকল্পনা ছোট পরিসরে শুরু করা প্রয়োজন। ছোট পরিসরে প্রথমে শুরু করা হলে ব্যবসায় পরিচালনার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সম্ভাব্য উন্নয়নের দিকগুলো সহজে চিহ্নিত করা যায়। ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। এরপর বড় পরিসরে ব্যবসাটি শুরু করা হলে তা টেকসই হয়। সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট দিনে ব্যবসা চালু করতে হবে। ব্যবসা চালু হলে প্রতিদিনের আয়-ব্যয় হিসাব করার জন্য নিজের মতো করে কাঠামো (ফরম্যাট) তৈরি করে নিতে হবে। প্রতিদিনের বিক্রির হিসাব, প্রতিদিনের ব্যয়ের হিসাব, সম্পদ রেজিস্টার আলাদা আলাদা করে সংরক্ষণ করতে হবে।

ধাপ-৮: গ্রাহক পরিষেবা এবং প্রতিক্রিয়া

ব্যবসায়ের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার জন্য ক্রেতাদের মতামত গ্রহণ ও চাহিদা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেতাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে ও ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে তাদের আত্মসম্মানে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। তাদের অভিযোগ ও মতামতের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ক্রেতাই হলো একটি ব্যবসার মূল পরিচালক। ক্রেতার নিকট থেকে কোনো অভিযোগ আসলে গুরুত্বসহকারে শুনতে হবে এবং অভিযোগ যাচাই করে তা দ্রুততার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তার চাহিদাকে কেন্দ্র করেই ব্যবসা আবর্তিত হয়ে। ক্রেতা না থাকলে কোনো ব্যবসাই সফল হবে না। একইসাথে, ব্যবসায়ের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব স্থানীয় পরিবেশ এবং প্রাণিকূলের স্বাস্থ্য হুমকি তৈরি করছে কি না, তা বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। এই ধরনের কোনো হুমকি তৈরি হলে সঙ্গে সঙ্গে তা প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ধাপ-১: ব্যবসায়ের ফলাফল মূল্যায়ন

ব্যবসা শুরুর পর তা কতটুকু সফল হলো, তা বিচারের জন্য আমরা যে কাজটি করি, তার নাম ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স মূল্যায়ন। ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স মূল্যায়নে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসার পারফরম্যান্স মূল্যায়নে আর্থিক অনুপাত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচের একটি ব্যবসার পারফরম্যান্স মূল্যায়ন প্রতিবেদনের নমুনা প্রদান করা হলো, যা অনুসরণ করে আমরা আমাদের ব্যবসার পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে পারি।

মন্তব্য: ব্যবসাটির আর্থিক অনুপাত খুবই ভালো অবস্থায় রয়েছে এবং ব্যবসাটি লাভজনক। পারফরম্যান্স হিসাবকাল অর্থাৎ ছয় মাসে ব্যবসা থেকে মোট মুনাফা হয়েছে ৩০০০০ টাকা এবং নিট মুনাফা হয়েছে ২৫০০০ টাকা। প্রতি মাসে ব্যবসা থেকে নিট লাভ হয়েছে (২৫০০০/৬) =৪১৬৭ টাকা প্রায়। ব্যবসায় নিয়োগকৃত মূলধন ২০,০০০ টাকা, যা ব্যবসা শুরুর (২০০০০/৪১৬৭)=৪.৮ মাসের মধ্যে ফেরত এসেছে। সুতরাং বলা যায়, ব্যবসায়টি টেকসই হবে।

ধাপ-১০: সাফল্য বা অর্জন উদ্যাপন করা

ব্যবসায়ের প্রতিটি পর্যায়ে সাফল্য ও অর্জন উদ্‌যাপন করা যেতে পারে। এই উদ্‌যাপন সামনে এগিয়ে যাওয়াকে উৎসাহিত করে। একই সঙ্গে, বাধা ও চ্যালেঞ্জ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। মনে রাখতে হবে, যেকোনো বাধা ও চ্যালেঞ্জ নতুন সম্ভাবনার পথকে উন্মোচিত করে। যেকোনো ব্যবসায় সফল করার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম, মানিয়ে নেওয়া এবং প্রতি মুহূর্তে শেখার মানসিকতা ইত্যাদি। 

সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে উদ্ভাবনী বিনিয়োগ ধারণা উন্নয়ন

আমরা সমাজে সবার সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করি। সমাজের একজনের সমস্যা যেমন অন্যদের প্রভাবিত করে, তেমনি সমাজে এমন অনেক সমস্যা আছে, যা দ্বারা আমরা প্রত্যেকেই প্রভাবিত হতে পারি। এই বিশ্বে এমন অনেক মানুষ আছে যারা সারা জীবন সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। আবার কেউ কেউ এই ধরনের কাজকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করে থাকেন অর্থাৎ সামাজিক সমস্যার নতুন নতুন উদ্ভাবনী সমাধান তৈরির মাধ্যমে নিজের আর্থিক চাহিদাও পূরণ করে। কীভাবে সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের উদ্ভাবনী সক্ষমতা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারি, তার সাথে পরিচিত হব।

এক: সামাজিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ

তোমরা কি কখনো লক্ষ করেছ, আমরা যে সমাজে বসবাস করি, সেখানে কী কী বাস্তব সমস্যা রয়েছে? কোন কোন বিষয় আমাদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়? একই সমাজে বসবাসকারী সবাই সমাজে বিদ্যমান সামাজিক সমস্যা অনুভব করে। ব্যক্তি জীবনে এবং পরিবার জীবনে মানুষের যেমন বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, তেমনি সমাজ জীবনেও মানুষকে নানা সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। হয়তো একই সমস্যার প্রভাব একেকজনের কাছে একেক রকম, কিন্তু সমাজে কোনো একটা সমস্যা থাকলে বা তৈরি হলে তার নেতিবাচক প্রভাবে সমাজের বেশির ভাগ সদস্যই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তোমরা কি তোমাদের এলাকার সামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে চাও, তার সমাধানে একটা উদ্ভাবনী আইডিয়া বাস্তবায়ন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চাও?

এমন অনেক উদাহরণ হয়তো তোমরা চারপাশে পাবে, যার সমাধানে সবাই মিলে একটু চেষ্টা করলে হয়তো পেয়ে যেতে পারো। সমস্যা সমাধানে একটি উদ্ভাবনী চিন্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। তোমরা যে যে এলাকা বা অঞ্চলে থাকো, সেখানে তোমাদের চারপাশে এমন কী কী সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান, যার সমাধান তোমরা করতে চাও? চলো, আমরা আমাদের এলাকার যেকোনো একটি ক্ষেত্র নির্বাচন করে আমাদের স্থানীয় সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকার এক বা একাধিক সমস্যাও চিহ্নিত করতে পারি। এখানে উল্লিখিত সমস্যার ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত যেকোনো একটি সমস্যার নিয়ে আমরা কাজ করব। যেমন: শিক্ষাক্ষেত্রে হতে পারে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি, কিংবা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস তৈরির জন্য একটি পাঠাগারের অভাব; অথবা এলাকার নিরক্ষর ব্যক্তিদের জন্য সাক্ষরতা অভিযান কর্মসূচি ইত্যাদি।

দুই: সমস্যা সমাধানের উপায় অনুসন্ধান

আমরা যে সামাজিক সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ একটি সমস্যা সমাধানের জন্য নির্বাচন করব। নির্বাচিত সামাজিক সমস্যাটি সমাধান করলে সত্যিকার অর্থে কারা উপকৃত হবে, তা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা জানি, একটা সমস্যার হয়তো অনেক সমাধান আছে। কিন্তু সমস্যাটিতে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে উক্ত সমস্যার কী ধরনের সমাধান তারা চান। যেমন: কোনো এলাকায় হয়তো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোবাইল ফোনে আসক্তি অনেক বেশি; ফলে তাদের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কগুলো ব্যাহত হচ্ছে এবং সুস্থ বিনোদনের অভাবে তারা নানা অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় মানুষ, পরিবারের সদস্য কিংবা তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অভিমত যাচাই করা জরুরি। কেউ হয়তো বলবে, মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ করতে, কেউ বলতে পারে- অপকর্ম করলে শাস্তি প্রদান করতে হবে, আবার কেউ হয়তো বলতে পারে- নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করলে এর প্রভাব কমতে পারে। এভাবে সকল সামাজিক সমস্যারই হয়তো এক বা একাধিক সমাধান হতে পারে। তাই এটা জেনে নেওয়া জরুরি যে, সমস্যাটা কাদের এবং তারা কী সমাধান পেলে সন্তুষ্ট হবে। দলের সবাই মিলে ২.৫ ছকটি পূরণ করার চেষ্টা করি। কাজটি করার জন্য প্রয়োজনে নিজ এলাকার সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে।

একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানে অনেকেই কাজ করতে পারে। তোমরা বন্ধুরা মিলে হয়তো ভাবছ, তোমাদের স্থানীয় একটি সমস্যার খুব দারুণ উদ্ভাবনী সমাধান পেয়েছ। একটু খোঁজ নিয়ে দেখো, অন্য কেউ তোমাদের মতো করে ভেবেছে কি না? অন্য কেউ কি এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে? কোনো ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠান এই সংক্রান্ত কাজ করছে কি না? নিজেদের এলাকায় কিংবা দেশের অন্য কোনো জায়গায় কেউ এরকম কাজ করছে কি না, তা খুঁজে দেখা দরকার। একই সঙ্গে তারা কীভাবে কাজগুলো করছে তা-ও পর্যালোচনা করতে হবে। তাদের কাছ থেকে শিক্ষণীয় কী আছে, তা ভেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কীভাবে আরও বড় পরিসরে কাজটি করা যায়, তা আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে।

তিন: সমস্যাটির প্রচলিত সমাধান বিশ্লেষণ এবং কার্যকর সমাধান আবিষ্কার

বর্তমানে সমস্যাটির প্রচলিত কোনো সমাধান যদি থাকে, তা আলোচনার মাধ্যমে বের করার পর অন্যান্য সমাধানগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রচলিত সমাধানগুলো কেন কাজ করছে না কিংবা সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না, তা দলে আলোচনা করো এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।

এবার মূল কাজ হলো, সমস্যাটির উল্লিখিত সমাধানগুলোর মধ্য থেকে একটি কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করা। কার্যকর সমাধান খুঁজে পেতে দলগত আলোচনার মাধ্যমে আমরা আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারি। সব ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য প্রস্তাবিত সকল সমাধান ভালোভাবে প্রক্ষেপণ করে দেখতে হবে। এবার কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দলের সকলের মতামত ও যৌক্তিক আলোচনার ভিত্তিতে কার্যকর একটি সমাধান নির্বাচন করতে হবে। সমাধানটিতে প্রচলিত সমাধান থেকে কতটুকু ভিন্নতা আছে, তা বের করতে হবে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত সমাধানটি কেন কার্যকরভাবে কাজ করবে, তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে হবে।

চার: সমস্যা সমাধানে দলগত উদ্যোগ

একটি কার্যক্রম পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্পন্ন করতে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী দল। একা কাজ করলে অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। তাই দলের জন্য উপযুক্ত সদস্য নির্বাচন করা খুবই জরুরি। কোনো একটি সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান করতে হলে দলের সবাইকে সেই সমাধানে অবশ্যই ঐকমত্য পোষণ করতে হবে। দলের সবার বিশ্বাস স্থাপনে প্রয়োজন যে, আমরা যে কাজটি শুরু করতে যাচ্ছি, তার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, দলে সবার ভূমিকা হয়তো সমান থাকে না। - কেউ প্রধান পরিকল্পনাকারী, কেউ বাস্তবায়নকারী, কেউ প্রচারকারী, কেউ সূক্ষ্ম কারিগরি কাজে সহায়তাকারী - হিসেবে কাজ করে। এভাবেই দলের সব ধরনের ভূমিকা পালন করার জন্য কোনো না কোনো সদস্য থাকা প্রয়োজন। কতজন সদস্য হলে খুব ভালো দল হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। তবে শুধু তাদেরই দলে নেওয়া উচিত যাদের এই ধরনের সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে দারুণ আগ্রহ আছে, সংশ্লিষ্ট কাজে উৎসাহী এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সময় দিতে পারবে। আমাদের নির্বাচিত সমস্যাটি সমাধানের উদ্দেশ্যে এবার আমাদের দলের জন্য ২.৭ ছকটি পূরণ করি:

সমাজের বা দেশের আর কোন কোন ব্যক্তি বা সংস্থা আমাদের উদ্ভাবনীমূলক এই কাজে সমর্থন ও সহায়তা করতে পারে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। যেমন: সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিও, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। পাশাপাশি যদি সামাজিক উদ্যোগটি বাস্তবায়নে কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদনের প্রয়োজন হয়, তাহলে সেসব পণ্য বা সেবা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বিক্রেতা ও প্রচার মাধ্যমগুলোকেও সমর্থক বা সহযোগী হিসেবে গণ্য করতে হবে।

পাঁচ: উদ্যোগের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা

আমরা যে সামাজিক সমস্যাটির উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি করেছি, তার ধাপগুলো ডায়াগ্রাম-ফ্লোচার্ট হিসেবেও উল্লেখ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে যেসব বিষয় লক্ষ রাখা প্রয়োজন তা হলো-

  • উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে যেসব কাজ অবশ্যই করতে হবে তার তালিকা প্রণয়ন। 
  • উদ্ভাবনী উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষ বা সমস্যার ভুক্তভোগীরা কী কী সুবিধা পাবে? 
  • সমাধানের ফলে কী প্রভাব হতে পারে? 
  • কী পরিবর্তন আনবে?
  • তালিকা অনুযায়ী দলের কোন কোন সদস্য কোন কাজটি করার জন্য দায়িত্ব নিবে তা নির্ধারণ করে নিতে হবে।
  • দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার পর সেই কাজটি সম্পন্ন করতে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং প্রতিটি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা উপকরণ নির্ধারণ করতে হবে।
  • দায়িত্ব বুঝে নিয়ে বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং প্রতি সপ্তাহে তার অগ্রগতি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কাজটির প্রতি সবাইকে সমান মনোযোগ ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করতে হবে। কেউ দায়িত্ব নিয়ে অবহেলা করলে তার কারণে পুরো দলের কাজ পিছিয়ে যেতে পারে। তাই সব ক্ষেত্রেই সকলের ঐকমত্য এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকা আবশ্যক। কাজের প্রতি অঙ্গীকার এবং আশানুরূপ বন্ধন না থাকলে অনেক সামাজিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়।

ছয়: বাজেট প্রণয়ন ও অর্থ সংস্থান

সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে দুই ধরনের ব্যয় নির্ণয় করতে হয়- ক) স্থির ব্যয় খ) পরিবর্তনশীল ব্যয়। যেসব ব্যয় পুরো কার্যক্রমে একবারই করতে হয়, এমন ব্যয়গুলো স্থির ব্যয় (fixed cost) নামে অভিহিত করা হয়; যেমন: যন্ত্রপাতি ক্রয়, অফিসের জন্য আসবাবপত্র ইত্যাদি। কাজের পরিধি পরিবর্তনের সঙ্গে যেসব খরচ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় বা মাসভিত্তিতে নিয়মিত খরচ করতে হয়, সেগুলোকে পরিবর্তনশীল ব্যয় নামে অভিহিত করা হয়; যেমন: যাতায়াত, টেলিফোন খরচ, ফটোকপি ইত্যাদি।

তবে স্থির ও পরিবর্তনশীল ব্যয়ের পরিমাণ নির্ভর করে সামাজিক উদ্যোগের ধরনের ওপর। কিছু উদ্যোগের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট অফিস, বেতনভুক্ত কর্মী এবং আইনগত ভিত্তির জন্য রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্থির ব্যয় বেশি হবে। আবার কিছু উদ্যোগের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, সেক্ষেত্রে সামগ্রিক খরচ কম হতে পারে।

ব্যয় যেমনই হোক না কেন, সামাজিক উদ্যোগটি শুরুর পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকল খরচ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া গেলে সেই ব্যয় বহন এবং অর্থসংস্থান করা সহজ হয়। এবার আমরা উদ্যোগটির জন্য কী কী খাতে ব্যয় হতে পারে তার বাজেট তৈরি করব: 

উদ্যোগের নাম: _ _ _ _ _ _ _

(ব্যয়ের খাত বেশি হলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লাইন যুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে।)

সামাজিক সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে দলের সদস্যদের সময় ও শ্রমসহ বিভিন্ন ধরনের খরচ বা ব্যয় হয়ে থাকে। কোন খাতে কত খরচ হবে, তা খুঁজে বের করার পাশাপাশি অর্থসংস্থান কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত সামাজিক উদ্যোক্তাগণ নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করেন। তবে এক্ষেত্রে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে সহায়তা বা অনুদান গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া আরো অনেক উৎস আছে, যেখান থেকে আমরা অর্থ সংস্থান করতে পারি; যেমন: সামাজিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অনুদান, দাতা সংস্থার অনুদান, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সিড তহবিল (seed funding), বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তির অনুদান, সদস্যদের এককালীন ও মাসিক চাঁদা, গণ-অর্থায়ন (crowd funding), বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সরশিপ বা পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি। আমরা আমাদের সামাজিক উদ্যোগটির জন্য কীভাবে তহবিল সংগ্রহ করব, তার একটা পরিকল্পনা করতে পারি। লক্ষ রাখতে হবে, সামাজিক উদ্যোগটি যদি সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণে কাজে আসে, তাহলে তার অংশীজনের নিজে থেকেই এর জন্য অর্থ খরচ করতে চাইবেন। এবার আমরা একটি ক্রাউড ফান্ডিং বা গণ-অর্থায়নের সফলতার গল্প শুনব।

একটি এলাকায় তালগাছ রোপণের জন্য ক্রাউড ফান্ডিং

এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলবর্তী অঞ্চলের একটি ঘটনা। ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা এই এলাকার প্রধান সমস্যা। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও বিভিন্ন বিষয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। সমাজের মানুষের বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য এগিয়ে এসেছেন হোসেন আলী নামের একজন কলেজ শিক্ষক। আলী লক্ষ করলেন, এই অঞ্চলে বিল বা ধানখেতের মাঝখান দিয়ে যেসব রাস্তা চলে গেছে, তার আশপাশে উঁচু গাছ বা স্থাপনা না থাকায় বজ্রপাতে প্রায়ই মানুষ ও গবাদিপশু মারা যাচ্ছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখলেন, এই বজ্রপাতের কারণে গত এক বছরে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ মারা গেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন কিছু একটা করবেন, যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানও হয়। যেই ভাবা সেই কাজ! তিনি পুরো অঞ্চলে ৫০ হাজার তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করলেন। তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও সঙ্গে নিলেন। কিন্তু এত তালগাছের চারা সংগ্রহ ও রোপণের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে যে পরিমাণ আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেল, তা ছিল অপ্রতুল। এজন্য তিনি একটি ভিন্ন কৌশল বেছে নিলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিজ্ঞাপন দিলেন এভাবে:

ব্যস, বিজ্ঞপ্তি দিতেই ব্যাপক সাড়া পড়ে গেল! দেশ-বিদেশের অনেকেই এই মহতী উদ্যোগে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এলেন। কেউ ১০০ টাকা, কেউ ৫০০ টাকা দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। এভাবে খুব অল্প সময়ে আলীর প্রত্যাশার চেয়েও বেশি টাকা উত্তোলন হলো। এরপর তিনি তার শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে রাস্তার দুই ধারে তালের চারা রোপণ করা শুরু করলেন। এভাবেই তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল গণ-অর্থায়ণের (ক্রাউডফান্ডিং) মাধ্যমে উদ্যোগটি সফলতার মুখ দেখল। এরপর থেকে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে তিনি এই পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে তিনি এই রকম একটি সামাজিক সমস্যার সমাধান করেছেন বলে পরবর্তী সময়ে তাকে অর্থ সংস্থানের জন্য সামাজিক কোনো কাজ থামিয়ে দিতে হয়নি। যেকোনো সৎ উদ্যোগের ক্ষেত্রে সমাজ সঙ্গেই থাকে।

এই গল্পে আমরা একধরনের অর্থসংস্থান সম্পর্কে জানলাম। এভাবে আরো যেসব উৎস থেকে আমরা সহায়তা পেতে পারি, তার একটি তালিকা তৈরি করব। এই তালিকায় নিজ এলাকায় বা দেশে ও বিদেশের যে কেউ বা যেকোনো সংস্থা থাকতে পারে। যদি আমরা কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারি এবং আমাদের কাজ ও পরিকল্পনার মজবুত ভিত্তি থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের উদ্যোগ বাস্তবায়নে অর্থসংস্থানের উপায় খুঁজে পাব। প্রয়োজনে এই উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করব।

সাত: মার্কেটিং ও প্রচার

আমাদের সামাজিক উদ্যোগটি হয়তো কোনো কার্যক্রম, কোনো পণ্য বা সেবা, যার মাধ্যমে সমাজের ভুক্তভোগী মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু এই বিষয়টি তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য দরকার একটি সুন্দর মার্কেটিং পরিকল্পনা। অংশীজনদের জানাতে হবে- তারা কখন, কোথায়, কীভাবে এটি গ্রহণ করতে পারবেন। যেমন: কেউ হয়তো স্থানীয় কোনো একটি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতি মাসে স্থানীয় মানুষদের বিনা মূল্যে চক্ষু পরীক্ষার ক্যাম্প চালু করতে চান। এক্ষেত্রে সব আয়োজন সম্পন্ন করার পরও যদি কোনদিন, কোথায়, কী পরীক্ষা করা হবে, তা স্থানীয় মানুষদের জানানো না হয়, তাহলে এই উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিংবা কেউ হয়তো স্থানীয় বাজার থেকে পণ্য-সদাই বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মতো একটি সেবা চালু করলেন, যাতে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং ওষুধ সময়মতো পান। এখন এই সেবাটি নেওয়ার জন্য যেসব পরিবার আগ্রহী, তাদের কাছে সেই তথ্য পৌঁছানো জরুরি। প্রয়োজন থাকলে বা সেবাটি গ্রহণ করার আগ্রহ থাকলেও না জানার কারণে অনেকেই সেবাটি থেকে বঞ্চিত হবেন।

মার্কেটিং শুধু পণ্যের বিজ্ঞপ্তি বা প্রচার নয়; বরং এটি গল্প। যেখানে কীভাবে উদ্যোক্তা ও ভোক্তা মিলে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করছে; কীভাবে সমাজে প্রচলিত সমস্যার সৃজনশীল সমাধান হচ্ছে; কীভাবে ছোটো ছোটো পদক্ষেপ একটি দীর্ঘকালীন সমস্যার সমাধান করছে ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, সমাজের সবাই শুরু থেকেই এই উদ্যোগে সাড়া দেবেন, এমন নয়। হয়তো অল্প কিছু উৎসাহী মানুষ প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করবেন। অধিকাংশ মানুষ হয়তো পর্যবেক্ষণ করবেন পদক্ষেপটি কেমন কাজ করছে! যদি খুব কার্যকর কোনো সমাধান হয়, তবে অবশ্যই এই সামাজিক উদ্যোগের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে। তখন হয়তো তারা এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করবে বা আমাদের পণ্য বা সেবা ক্রয় করবে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদে হয়তো তারাই এই উদ্যোগের দূত বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন।

মার্কেটিং বা প্রচার করার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় লক্ষণীয়-

  • উদ্যোগের সম্ভাব্য ক্রেতা বা ভোক্তাকে (ব্যক্তি, সংগঠন, ব্যবসায়ী, সরকার ইত্যাদি) লক্ষ করে প্রচার;
  • পণ্য/সেবা/কার্যক্রমের ইতিবাচক উপস্থাপন;
  • সরাসরি আর্থিক সংশ্লেষ সম্পর্কে না বলে, কীভাবে এই উদ্যোগ, পণ্য বা সেবা ভোক্তার সমস্যা সমাধান করছে তা উপস্থাপন;
  • নিজেদের দলের সক্ষমতা ও সেবা প্রদানের অঙ্গীকার প্রদর্শন;
  • ভুক্তভোগী বা ভোক্তা কীভাবে উপকৃত হচ্ছেন, তার প্রমাণ উপস্থাপন;
  • কেন ভোক্তা বা ভুক্তভোগী এটি ব্যবহার করবেন বা এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করবেন তা ব্যাখ্যা করা;
  • এই উদ্যোগ, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে ভোক্তা বা ভুক্তভোগীদের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন।

মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে। নিজেদের সামর্থ্য, দক্ষতা ও প্রয়োজনীয়তা এবং ভোক্তার সামর্থ্য উপলব্ধি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মাইকিং, পোস্টার, লিফলেট, বক্তৃতা, চিঠি ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্কেটিং বা প্রচার করলেই যে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে এসে এই উদ্যোগে যুক্ত হবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও এই প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে কোনটা বেশি কার্যকর, তা খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করতে হবে; এরপর নিয়মিত পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।

আট: বাস্তবায়ন শুরু

ইতিমধ্যে আমরা সামাজিক একটি সমস্যা নির্বাচন করে তার সৃষ্টিশীল সমাধান বা পদক্ষেপ খুঁজে বের করেছি, সমস্যা সমাধানে আমাদের সহযোদ্ধাদের নির্বাচন করেছি, ধাপে ধাপে উদ্যোগটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এবং কে কোন দায়িত্ব পালন করবে তার পরিকল্পনা করছি, এই উদ্যোগটি বাস্তবায়নে কী পরিমাণ অর্থ খরচ হবে এবং কত আয় হতে পারে তার হিসাব নিকাশ করেছি। এছাড়া উদ্যোগটি বাস্তবায়নে অর্থ সংস্থানের উপায় বের করেছি, উদ্যোগটি বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে সবার কাছে পৌঁছাবে, তার ব্যবস্থা করেছি।

মনে রাখতে হবে, অনেক দীর্ঘ একটি যাত্রাও শুরু হয় ছোটো একটি পদক্ষেপ থেকে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য যত বড়ো হোক না কেন, শুরু করতে হবে ক্ষুদ্র আঙ্গিকে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে আমাদের উদ্যোগটি শুরু করব এবং উদ্যোগটি কতটা কার্যকরভাবে কাজ করছে, তা সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করব। প্রতিটি পদক্ষেপ ভিন্ন ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে দেখব। উদ্যোগ বাস্তবায়নে পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল পদক্ষেপ কাজে পরিণত করার চেষ্টা করব। প্রথম দিকে কিছু বিষয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে, কিছু পদক্ষেপ কাজ না-ও করতে পারে, কিছু পদক্ষেপ সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এগুলো খুবই স্বাভাবিক। লক্ষ্যের দিকে অবিচল থেকে বাস্তবায়ন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। শুরুতে আমরা যাদের জন্য কাজ করব, তারা আমাদের পদক্ষেপে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, অবিশ্বাস করতে পারে; তাতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। সততা ও নিষ্ঠা বজায় রেখে, ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। একসময় হয়তো অধিকাংশ মানুষ আমাদের উদ্যোগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে। হয়তো তারা আমাদের সহযাত্রী হয়ে যাবে, মূল প্রতিনিধি হিসেবে তখন তারাই কাজ করবে। বিশ্বের প্রায় সকল বড় বড় উদ্যোগই প্রথমে বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, যারা নিষ্ঠার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ চালিয়ে যেতে পেরেছে, তারাই সফল হয়েছে।

ফিরে দেখা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সামাজিক উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। বেশির ভাগ সামাজিক উদ্যোগ হলো অলাভজনক। অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীর স্বেচ্ছাসেবাধর্মী অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক উদ্যোগকে সফল করতে হয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে সামাজিক উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। স্বল্প পরিসরে বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নির্দিষ্ট সময় পরপর সামাজিক উদ্যোগটি কতটুকু সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা জানা দরকার। একই সঙ্গে বাস্তবায়ন থেকে কী ধরনের শিক্ষণীয় বিষয় আছে, যা এই উদ্যোগকে আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে কাজে লাগবে, তা জানার চেষ্টা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করব:

  • পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে কি না? কোন কোন কাজ পরিকল্পনামাফিক করা সম্ভব হয়নি এবং কেন?
  • দলের সবাই নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কি না? দলের কোনো সদস্যের দায়িত্ব পালনে বিশেষ কোনো সহায়তা প্রয়োজন কি না, সেক্ষেত্রে কী ধরনের সমর্থন প্রয়োজন?
  • কোনো ধাপের কাজ অসম্পূর্ণ থাকলে তার কারণ কী এবং কীভাবে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে?
  • সামাজিক উদ্যোগটি সম্পর্কে এর সুবিধাভোগী বা অংশীজনদের মতামত কী?

স্বল্প পরিসরে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার পর পুরো কার্যক্রমের মূল্যায়ন করতে হবে। সামাজিক উদ্যোগটি কতটা সফলভাবে ভুক্তভোগীদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করছে এবং উদ্যোগটি বড় পরিসরে বাস্তবায়নের উপযুক্ত কি না, তা জানার জন্য সামাজিক উদ্যোগটির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। ছক ২.৯ এর চেকলিস্ট অনুসরণপূর্বক আমরা বুঝতে পারব একটি সামাজিক উদ্যোগ কতটা সফল এবং এটা বড় পরিসরে বাস্তবায়নযোগ্য কি না?

আত্ম-প্রতিফলন

আমরা দলগতভাবে একটি সামাজিক সমস্যার সমাধান বের করার জন্য কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে। সকলের সহায়তায় সামাজিক উদ্যোগটি ছোট পরিসরে বাস্তবায়ন করে দেখেছি উদ্যোগটি কতটুকু সফলভাবে ভুক্তভোগীদের সহায়তা করতে পারছে।

চলো এবার আমরা দেখি, এই পুরো কাজটি বাস্তবায়ন করতে ব্যক্তিগতভাবে নিজের কেমন লেগেছে-

  • কোন কাজটি সহজ ছিল? কেন?
  • কোন কাজটি চ্যালেঞ্জিং ছিল? কেন?
  • কোন কাজটি বা অভিজ্ঞতাটি বিস্ময়কর ছিল? কেন?

উদ্ভাবনী বিনিয়োগ আইডিয়া মার্কেটিং করি

বিভিন্ন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত বা উদ্ভাবনীমূলক কিংবা, কোন পরিস্থিতিতে আইডিয়াটি একটি সফল ব্যবসায় পরিণত হবে, তা বোঝার জন্য খুব দারুণ একটি কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে। সেটি হলো- বিভিন্ন অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানা। ব্যবসায়িক আইডিয়া তৈরির পর, দলগতভাবে উপস্থাপনের জন্য অভিভাবক ও সুবিধাভোগীদের (স্টেকহোল্ডার) নিয়ে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে পারে। এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হবে- শিক্ষার্থীদের ব্যবসায়িক আইডিয়াগুলো অভিভাবক ও অংশীজনদের সামনে উপস্থাপন, মতামত গ্রহণ ও ব্যবসায়িক আইডিয়া বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ, বিনিয়োগকারীর সন্ধান ইত্যাদি। আমরা যে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করব, তা একত্র করে পরিকল্পিতভাবে বিদ্যালয়ে একটি সুচারু অনুষ্ঠান/ইভেন্ট পরিচালনা করব। পুরো আয়োজনটি সফল করতে পূর্বের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দলগতভাবে একটি পরিকল্পনা করতে হবে, যেখানে অনুষ্ঠানের সময়, তারিখ, স্থান, ভেন্যু নির্বাচন, অনুমতি গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অনুষ্ঠানটি সফলভাবে আয়োজন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিটি গঠন করে দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে; যেমন:

একটা অভিজ্ঞতার গল্প শুনি।

পিয়ালদের বাসা মফস্বলের একটা কানা গলিতে। ওরা রোজ বিকেলে সেখানে খেলতে বের হতো। আশে পাশের বাসার ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও আসতো। তাদের পাড়ায় একটা রেওয়াজ ছিল, এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য বছরে একবার ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। পাড়ার বড় ভাইয়া আর আপুরা মিলে সেই প্রতিযোগিতা চালাতেন। এজন্যে পাড়ার প্রায় প্রতি বাড়ি থেকে মাসে ৫ টাকা করে জমা দিতে হতো 'খেলাঘর' নামক একটা মাটির ব্যাংকে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে শুরু হতো প্রতিযোগিতার তোড়জোড়। মাসের আধাআধি হলেই সবাই ব্যস্ত হয়ে যেত রিহার্সেলে। বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী দল ভাগ করা হতো। খেলা হতো নানা ইভেন্টের- দৌড়, দড়িলাফ, মোরগ লড়াই, ব্যাডমিন্টন, লাটিম ঘুরানো, চেয়ার পাতা এবং যেমন খুশি তেমন সাজো! পাড়ার বড়রাও এই আনন্দের অংশীদার হতো। 'খেলাঘর'-এ জমানো টাকা দিয়ে রঙিন কাগজ কেনা হতো পাড়া সাজানোর জন্য, প্রাইজ কেনা হতো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের জন্য। এ ছিল যেন এক আনন্দযজ্ঞ! কিন্তু হঠাৎ করেই এই আনন্দে ভাটা পড়ে যায় গলির মুখে খোলা একটি দোকানের জন্য। দোকানটি ছিল একসময় মুদি পণ্যের। কিন্তু এখানে নতুন করে রাখা শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের সিগারেট। এর ফলে সারাক্ষণ ধুমপায়ীরা এখানে গলির মুখে ভীড় জমাতে থাকেন। সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়ায় গলির পথে চলাচলই দায় হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের খেলাধুলা, হৈচৈ আর আনন্দ করার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়।

খুদে খেলোয়াড়ের দল এই সমস্যা সমাধানে অনেক চেষ্টা করল। বড়দের কাছে গিয়ে সমস্যার কথা জানালো, তাতে লাভ হলো না। পরে তারা গলির মুখে পোস্টার লাগালো 'এখানে ধূমপান নিষেধ'; তাতেও কিছু হলো না। অবশেষে তারা সবাই মিলে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল দোকানের মালিকের সাথে কথা বলার। একদিন বিকেলে তারা সবাই মিলে দোকানের মালিকের সাথে বসল, তাকে বোঝালো তাদের সমস্যার কথা। দোকানের মালিক প্রথমে রাজী হলেন না। ওরা তখন আইনের প্রসঙ্গ নিয়ে আসলো। তারা বললো, যদি তিনি এখানে সিগারেট বিক্রয় বন্ধ না করেন, তাহলে প্রতিদিন এখানে উন্মুক্ত স্থানে ধুমপানের শাস্তি হিসেবে লোকেদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে। অবশেষে তিনি তাদের পক্ষে সায় দিলেন। বন্ধ করলেন সিগারেট বিক্রয়। পাড়াটি আবার ফিরে পেল তার পুরানো জৌলুস। বাচ্চারা ফিরে পেল তাদের খেলাধুলা আর নির্মল আনন্দ।

গল্পের নায়ক পিয়াল তখন সবে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর তার বন্ধুরা প্রায় তার কাছাকাছি শ্রেণিতেই পড়ত। তাই আমরা যদি ভাবি, সামাজিক উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব শুধু বড়দের, তা কিন্তু ঠিক নয়। মাঝে মাঝে আমরা ছোটরাও অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারি! সামাজিক এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের সবার এগিয়ে আসা জরুরি। তাতে আমাদের সুবিধাই বেশি। এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে গিয়ে আমাদের মাঝে যোগাযোগ, সূক্ষ্ম চিন্তন, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যা সমাধান দক্ষতা এবং সহযোগিতামূলক দক্ষতা অর্থাৎ সমাজে মিলেমেশে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার দক্ষতা বিকশিত হবে। আগামীতে এসব দক্ষতাই আমাদের নতুন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সক্ষমতা তৈরি করবে। শুধু তাই নয়, উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে উঠার গুণাবলিও এই ধরনের অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা অর্জন করতে পারি।

যেকোনো উদ্যোগ সফল হওয়ার পূর্বশর্ত হলো সততা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিক মূল্যাবোধ ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের উদ্যোগ নিতে হয়, যেন তা আমাদের আবেগ, অনুভূতি ও হৃদয়কে স্পর্শ করে। ব্যবসায়ের উদ্যোগের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই আমরা ব্যবসায়ের আইডিয়া তৈরি করার সময় অবশ্যই সামাজিক মূল্যবোধ, সততা ও পরিবেশসহ ব্যবসায়ের সব ধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ করব। তবেই আমরা একটি সুন্দর, শান্তিময় ও টেকসই আগামীতে পৌঁছাতে পারব। আমরা জানি, আগামীর প্রযুক্তিময় পৃথিবীতে নিজের পেশা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। তাই প্রত্যেকের মাঝেই নতুন নতুন আইডিয়া বিকশিত হওয়া চাই! শ্লোগান দিয়ে উদ্যোগটা শুরু হোক-

উদ্যোক্তা হয়ে যাত্রা করি- স্বপ্ন পূরণের পথে

উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে চড়ি বিজয় রথে!

Content added || updated By
Promotion